ভাগারে সন্ধ্যাবাতি প্রজ্জ্বলিত হইলে রাজচক্রবর্তী রাজা জনার্দন শঙ্খনিনাদে কুলশ্রেষ্ঠ সর্বলোকগামী ত্রিকালদ্রষ্টা পন্ডিত হুতোমকে আহ্বায়নের নিমিত্ত সুর ধরিলেন। আকাশ বিদীর্ণ করিয়া বাতাসবাহিত হইয়া হুতোম পন্ডিতের দরবারে রাজার প্রার্থনা পৌঁছাইল। হুতোম বিনয়ী হইয়া জ্ঞানগহ্বর হইতে পক্ষবিস্তার করিয়া পৎপৎ শব্দচক্রে আরোহন করিয়া রাজার সভাগারে আগমন করিয়া কহিলেন, "হে সুরশ্রেষ্ঠ দানবীর রাজা জনার্দন, কি নিমিত্ত আমাকে আনয়ন করিলে তাহা ইহক্ষণে কহিয়া ফেল।"

রাজা জনার্দন হুতোম ঋষিকে করজোড়ে দণ্ডবৎ হইয়া কহিলেন, "হে জ্ঞানদা ত্রিকালবেত্তা অগ্রদ্রষ্টা হুতোম, ভারতবর্ষে মনুষ্যপ্রজাতি হইতে পশুপ্রজাতিতে রূপান্তরণের কাহিনী শুনিতে চাই। আপনি আমাদিগের জ্ঞানবর্ধন করুন।"

ক্ষণিক স্থির থাকিয়া পক্ষাঘাতে সন্ধ্যাবাতি উল্টাইয়া হুস করিয়া উড়িয়া হুতোম কুলুঙ্গির ভেতর বসিয়া কহিতে লাগিলেন, "হে বিশ্ববরেণ্য নরপতি, পুরাকালে ভারতবর্ষে মনুষ্যজাতির আধিপত্য খর্ব হইলে পশুপ্রজাতি ক্ষণকাল বর্ষময় রাজত্ব করিয়াছিল। শ্রুত আছে যে মনুষ্যপ্রজাতিকে বঞ্চিত করিয়া বৃষরাজ নরেন্দ্র ক্ষণকাল রাজত্ব করিয়াছিলেন। তৎকালে পশুসকল মনুষ্যাদির অনুকরণ করিয়া দেহাচ্ছাদনে বস্ত্রাদি ব্যবহার করিত তথা মনুষ্যপ্রজাতি সম ভাষ্য কহিত। কথিত আছে, পশুসকলের বশবর্তী হইয়া মনুষ্যসকল পোষ্যপ্রজার ন্যায় জীবনযাপন করিত।"

"হে যুগরাজ যুবরাজ জনার্দন, পশুরাজসকল মানব মানবীকে তাহাদের দাস নিযুক্ত করিত। পশুসকল মস্তিষ্ক হইতে বিষ্ঠাত্যাগ করিত। মনুষ্যজাতি তদ্বারা মানসিক ক্ষুণ্ণবৃত্তি নিবারণ করিত। ইহার ফলস্বরূপ বৃষ, ষন্ড, গাভী ও শাখামৃগের আধিক্য বহুগুণ বৃদ্ধি পাইল। তৎকালীন পূণ্যাহূতি গোবরবিষ্ঠার অভাব ঘুচিল। মস্তিষ্কের উপাদানগুলি গোবরখচিত করিয়া পশুসকল দন্তনিধি বিকশিত করিয়া উচ্চে পুচ্ছ তুলিয়া দিব্যানন্দে বিরাজ করিত। মানবগণ পুচ্ছহীন হইলেও দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে পুচ্ছবর প্রার্থনা করিত।"

"হে জনার্দন, কৈলাসপতি মহাদেব খুশি হইয়া মনুষ্যপ্রজাতিকে অবশেষে পুচ্ছবর বর দিয়াছিলেন। পুচ্ছবরপ্রাপ্ত হইয়া অযুত সংখ্যাধিক মনুষ্য দিব্যশক্তিদ্বারা শাখামৃগে পরিণত হইল। অর্থাৎ সুরপতি দশরথপুত্র রঘুপতি রামের ভক্তের সংখ্যাধিক্য দর্শিত হইল। তখন দিগন্ত হইতে তেপান্তর পর্যন্ত শাখামৃগরূপী মনুষ্যপ্রজাতি পুচ্ছ নাচাইয়া করতাল দিয়া রাজার গুণকীর্তন করিত। গর্দভসকল ঢক্কানিনাদে গলতান করিত। ষন্ডসকল দম্ভিত হইয়া শিঙ উঁচাইয়া প্রলয়নট্য রচনা করিত। আনন্দরাগে বৃষসকল প্রলয়নৃত্য করিত।"

"হে শান্তিসূত প্রজাপরায়ণ জনার্দন, গাভীকে মাতা বিবেচনা করিয়া বৃষদল ও মনুষ্যদলে অহর্নিশ কোলাহল হইত। বিবাদ ঘোষিত হইত। এই সময়ে যুদ্ধং দেহি ভাবালম্বন করিয়া লক্ষাধিক বৃষসেনা একত্রিত হইয়া মনুষ্যাদির ওপর প্রহার করিত। গোবরের উৎপাদন বৃদ্ধির উপলক্ষ্যে বৃষরাজ গোবর্ধন যজ্ঞ করিতেন। উহাতে গোকীর্তন হইত। আহ্লাদিত হইয়া ষন্ডগোষ্ঠী হাম্বানিনাদ সহকারে বিষ্ঠা উৎপাদন করিত। মনুষ্যসকল বিষ্ঠামর্দন করিয়া পশুধর্ম পালন করিত।"

কিঞ্চিৎ উষ্ণশ্বাস ত্যাগান্তে সর্বলোকগামী হুতোম দীর্ঘশ্বাস লইয়া কহিলেন, "ফলস্বরূপ, ভারতবর্ষে মনুষ্যপ্রজাতি ক্রমে পশুপ্রজাতিতে রূপান্তরিত হইতেছিল। এইরূপ বৃষরাজের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইল।"

এমৎ কহিয়া হুতোম পক্ষস্ফীত করিয়া পুনরায় হুসহুস শব্দবাণে চড়িয়া জ্ঞানগহ্বরের উদ্দেশ্যে প্রস্থান করিলেন। রাজা জনার্দন ও সভাসদবর্গ হুতোম পন্ডিতকে ষাষ্টাঙ্গে প্রণাম নিবেদনপূর্বক সভাকক্ষ ত্যাগ করিলেন।