বাজারে আজকাল তো সবকিছুই পণ্য। ডিগ্রি কেনা যায়। চাকরি কেনা যায়। বিচার কেনা যায়। শিক্ষা কেনা যায়। মেয়ে কেনা যায়। আবার জামাই কেনা যায়। নেতা কেনা যায়। দল কেনা যায়। বিশ্বায়নের ব্যবস্থাপনায় সব কিছুই কেনা যায়। পায়সা ফেকো তামাশা দেখো। এসব আমরা দেশোয়ালিতে বলেই থাকি। বেচাকেনার এই যুগে আমাদের দেশে তেল থেকে রেল সব কিছুই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। আগের সরকার তেল বেচেছে। এই সরকার রেল বেচছে। শুনছি চাঁদ আর মঙ্গলে জমি কিনছে বড়লোকেরা! সব কিছু বেচা যায়। আবার সব কিছু কেনাও যায়।

এই সব দেখে আমার একটা শিরদাঁড়া কেনার শখ হল। এমন একটা শক্তপোক্ত শিরদাঁড়া যেটা তাল গাছের মতো সোজা হবে। বাজারে বেরিয়ে একটা ঝাঁ চকচকে মলে দাঁড়া কেনার স্টলে ঢুকে পড়লুম। এখানে থরে থরে শিরদাঁড়া সাজানো। ছোট, বড়, মাঝারি, ব্যাঁকা, ট্যারা। একটা কঙ্কালের ওপর আঙুলের টোকা দিতেই একটা দাঁড়া একটু বেঁকে গেল। এটা কিরকম কান্ড রে বাবা! শিরদাঁড়ায় জোর নেই। আঙুলের টোকায় অষ্টবক্র! সেলসম্যানকে ডেকে বললুম, এই যে ভাই আপনাদের দোকানটা সাজানো। কিন্তু জিনিসগুলো তো পলকা!

সেলসম্যান একটু হেসে নিয়ে নরম সুরে বলল, স্যার, আমাদের এখানে বিভিন্ন ধরণের শিরদাঁড়া পাওয়া যায়। আপনি যে শিরদাঁড়ায় টোকা দিলেন ওটা বুদ্ধিজীবি শিরদাঁড়া। এগুলো এতই পলকা যে ফুঁ দিয়েই বেঁকিয়ে ফেলা যায়। খুবই হালকা। বুদ্ধি খাটিয়ে এরা আবার হাওয়া বোঝে। কোন দিকে লেজ রাখতে হবে আর কোন দিকে মুড়ো সেগুলো এদের কাছে জলভাত। বুদ্ধিদীপ্ত এইসব শিরদাঁড়া বুদ্ধি করে বেঁকে যায়। এদের আমরা সেলিব্রিটি শিরদাঁড়া বলি স্যার। এটা আপনি কিনে নিন। ঠকবেন না স্যার। এটার বিক্রি বেশি। আমি কথা দিচ্ছি। ভবিষ্যতে আপনি এটা দিয়ে বাড়ি, গাড়ি, জমি, কোম্পানি সব করে ফেলতে পারবেন। এটা মাদুলি ভেবে সঙ্গে রাখবেন। আপনার উন্নতি কে আটকায়! রাহু কেতু শনি - এইসব তুচ্ছ ব্যাপার হয়ে যাবে আপনার কাছে।

এই শিরদাঁড়া আমার পছন্দ হলনা। সেলসম্যান কিন্তু বুঝে গেছে আমার একটা শিরদাঁড়া লাগবে। তাই আর পিছু ছাড়তে চাইছেনা। আরেকটা শিরদাঁড়ার কাছে গিয়ে জোরে ফুঁ মারলুম। শিরদাঁড়াটা বেঁকে না গিয়ে হাওয়ায় একটু দোল খেল। সেলসম্যানটা আমার কার্যকলাপ দেখে নিজের পার্স থেকে একটা পাঁচশো টাকার নোট বের করল। আমার হাতে দিয়ে বলল, স্যার, এইটা এবার ওটার সামনে নাড়িয়ে দিন। আমি তাই করলুম। নোটটা দুই আঙুলে চেপে ধরে হাওয়া দেওয়ার কায়দায় শিরদাঁড়ার কাছে নাড়িয়ে দিলুম। ও মা! একি কান্ড। শিরদাঁড়াটা বেঁকে গেল। আমি তো হাঁ! ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করলুম, এটা কার শিরদাঁড়া ভাই! ছেলেটা বলল, এটা সাধারণ মানুষের শিরদাঁড়া স্যার। এটা পাঁচশো টাকায় বেঁকে যায়।
এটাও আমার পছন্দ হলনা। ছেলেটাকে বললুম, তুমি আমার পছন্দ মতো জিনিস এখনো দেখাতে পারোনি। আরেকটা দেখি চলো। সেলসম্যান এবার আমার আগে আগে গিয়ে একটা শিরদাঁড়ার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। এই যে স্যার, এটা দেখুন। দেখতে খুবই মজবুত স্যার। কারোর কথায় বেঁকবেনা। ভাঙবেনা। মচকাবেনা। আমি তো একটু রেগেই গেলাম এবার। কোথায় শিরদাঁড়া ভাই! আমার সঙ্গে কি ইয়ার্কি মারছ! আমি তো একটা কাঁচের ঘর দেখতে পাচ্ছি। এপার থেকে ওপার দেখতে পাচ্ছি। এরমধ্যে শিরদাঁড়া কোথায়!।

ছেলেটা কাঁচের ঘরে গর্বের টোকা মেরে বলল, স্যার এটা মিডিয়ার শিরদাঁড়া। একেবারে স্বচ্ছ। কাঁচের ঘরটাই একটা শিরদাঁড়া। আমি অবাক হয়ে বললুম, সেকি বলো ভাই! এটা শিরদাঁড়া! কারা ব্যবহার করে ভাই! ছেলেটা এবার পকেট থেকে একটা চশমা বের করে বলল, এটা পরে দেখুন একবার স্যার। বুঝতে পারবেন। আমি টক করে চশমা পরে ফেললুম। এ বাবা! একি দেখছি! কাঁচের ঘরের মধ্যে কিলবিল করছে কেঁচো! নোংরা। দুর্গন্ধ! আমি ঘেন্নায় চশমা খুলে ফেললুম। ছেলেটাকে বললুম, এগুলো তো কেঁচো। ছেলেটা অমনি বলল, না স্যার। এরা সাংবাদিক। এরা শিরদাঁড়ার মধ্যেই থাকে। আসলে এরা স্পাইনলেস। এরা মিডিয়ার শিরদাঁড়ার মধ্যে বসবাস করে। আমি বললুম, আমার কিন্তু পছন্দ হলনা ভাই। এত প্যাঁচের মাল আমি চাইনি।

ছেলেটা কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্র মনে হচ্ছে না। আরও উৎসাহ নিয়ে আমাকে নিয়ে আরেকটা শিরদাঁড়ার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, এটাকে দেখুন স্যার। এটা রঙ পালটায়। তেরঙ্গা শিরদাঁড়া এটা। এরা তিনটে রঙের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। আমার বেশ পছন্দ হল ব্যাপারটা। আমি ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করলুম, এটা তো বেশ ভাল মনে হচ্ছে। কিন্তু এটা কি বেঁকবে। ছেলেটা আমার কথা শেষ করার আগেই শুরু করল, স্যার, আগের ফিচারগুলো তো থাকছেই। তারসঙ্গে রঙ পালটানোর নতুন ফিচার জুড়ে দিয়েছি। আজকাল এটাকে সবাই ম্যাক্স প্রো শিরদাঁড়া বলে ডাকে। এটা নিতে পারেন স্যার। এটা নেতাদের শিরদাঁড়া। আমি বেজার মুখে বললুম, না ভাই, থাক।

আমার এইসব জঘন্য শিরদাঁড়া একেবারেই নাপসন্দ। আমি দাঁড়া খুঁজতে দোকানটার একটা কোণায় রাখা একটা শিরদাঁড়ার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছি। ছেলেটা পেছনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। কিছু বলছেনা। আমি ফুঁ দিলুম। শিরদাঁড়া নড়লনা। আমি পকেট থেকে পাঁচশো টাকা বের করে নাচিয়ে দিলুম। ওটা বেঁকলনা। আমি পুরো পার্সের টাকা ওটার ওপর ছিটিয়ে দিলুম। ওটা কুঁজো হয়ে তাকিয়ে পর্যন্ত দেখলনা। আমি ওটার ওপর জোরে ধাক্কা দিলুম। ওটা ঠায় দাঁড়িয়ে! ছেলেটা ততক্ষণে একটা লাঠি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলছে, স্যার, এটার ওপর দু’ঘা দিয়ে দেখুন। আমি তাই করলুম। শিরদাঁড়াটা একচুলও এধার ওধার হলনা।

আমি আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে দেখছি। এটা কি ধরণের শিরদাঁড়া। আমার চিন্তায় ব্যাগড়া দিল ছেলেটাই। লাঠিটা দেখিয়ে আবার বলল, এবার আপনি আগের চেয়েও জোরে মারুন স্যার। খুব জোরে। আমি তাই করলুম। ছেলেটা মুচকি হেসে বলল, কিছু ফিল করলেন স্যার। দিস ইজ মেরুদন্ড। নট অ্যা বংশদন্ড। আমি নিস্তেজ হয়ে বললুম, হ্যাঁ ভাই, হাতে খুব লেগেছে। এই ধর তোমার লাঠি। আমার এটাই চাই। আমি এটাই খুঁজছিলুম। কিন্তু এই ধরণের শিরদাঁড়া দোকানের সামনের দিকে সাজিয়ে না রেখে একেবারে পেছন দিকে ফেলে রেখে ধুলো খাওয়াচ্ছ কেন!

ছেলেটা বলল, পাবলিক এটা কেনেনা স্যার। পাবলিক নিচ্ছেনা। তাই পেছনে ফেলে রেখেছি।