যিনি কাব্য সৃষ্টি করেন তিনি কবি। আর যিনি পদ্য লেখেন তিনি পদি। লীলা মজুমদারের সৃষ্ট সাহিত্যে একটি মজাদার চরিত্র ছিলেন পদিপিসি। কবি আর পদির ছান্দিক মেলবন্ধনের সুরঝঙ্কারে কবির ভাবনাগুলো পটাপট কাব্যিক হয়ে যাচ্ছে। পদির ভাবনার পাদ্যিক সুগন্ধের আবহে ঠ্যাং তুলে ড্যাং ড্যাং করে নেচে নেচে কাব্যিক ও পাদ্যিক স্তরের বিশ্লেষণ করতে চাইছি।

উপরোক্ত প্রেক্ষাপটে কবি মমতার কবিতা সংগ্রহ এবার আকাডেমি পুরস্কার পেল। তাঁর সৃষ্ট কাব্যসংকলন 'কবি তাবি তান'এর প্রতিটি কবিতাই গভীর চিন্তাবাহক ও সমাজের সবরকম অশুভ তত্ত্বের ওপর চপেটাঘাত কিংবা কুঠারাঘাত। ঘাতঘোঁত দেখে ঝপাং করে হেসে পটাং করে কেশে নিলে এই কবিতার মূলার্থ কেউ উদ্ধার করতে পারবেনা। এর মধ্যে সে যুগ আর এ যুগের মহামিলনের সূত্র আছে। এই প্রসঙ্গে পরে আসব। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাডেমির বিদগ্ধ পন্ডিতবর্গ সেই সুত্র ধরেই কবির সাহিত্যকীর্তিকে তাঁদের নিরলস প্রচেষ্টায় সেরার শিরোপা দিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে কবির এই অপরূপ কবিতা সম্ভার বাংলার সাহিত্যকে অলঙ্কৃত করল।
 
প্রথম স্তবকঃ
"এপাং ওপাং ঝপাং
আমরা সবাই ড্যাং ড্যাং 
চলো দেখি কোলাব্যাঙ 
প্রজাতির আছে কি ঠ্যাং ?"

কবিতার প্রথম স্তবকে কবি শুধু বিশেষ কোন সমাজ বা গোষ্ঠীর বর্ণনা করেননি। তিনি পুরো বিশ্বপটলের প্রেক্ষিতে আধমরাদের উজ্জীবিত করতে চেয়েছেন। এখানে কবি বলেছেন, 'চলো দেখি কোলাব্যাঙের কত বড় ঠ্যাং ?' অর্থাৎ ব্যাঙ কুয়োর মধ্যে বসে না থেকে ঠ্যাং ঠাটিয়ে কুয়ো থেকে লাফিয়ে উঠে পড়লে চক্ষুপটলে শুধু পটল ছাড়া আরও অনেক কিছু ধরা পড়বে। জ্ঞানের ভান্ডার তখন পুরো প্যান্ডোরা'জ বক্স। একটার পর একটা খুলবে। ব্যাঙের জ্ঞান বাড়বে। কবি ব্যাঙকে প্রতীকি শব্দ হিসেবে ব্যবহার করে সমাজকে সূক্ষ্ম অথচ সুরসমৃদ্ধ একটি বার্তা দিতে চেয়েছেন।

এই বার্তার চিত্রাঙ্কন করতে গেলে মনে হতে পারে এপাং আর ওপাং লাফ দিয়ে ঝপাং করে পড়ে গেছে। কিন্তু কবির কাব্যিক ভঙ্গিমা এপাং ওপাং ও ঝপাং-কে তিনটি পৃথক চরিত্র হিসেবেই দেখছে। মহাজাগতিক বিশ্বে এপাং-কে যদি এ দেশের লোক কল্পনা করা হয় তবে ওপাং মানে বিদেশের লোক। মহাজাগতিক পরিদৃশ্যে কবির কাব্যিক সূত্র ধরে চিন্তা করলে ঝপাং তবে ভিনগ্রহের লোক। অর্থাৎ বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের পুরো থিমটাই লুকিয়ে আছে কবির নিরলস সৃষ্টি সাধনার ভিত্তিপ্রস্তরে। তাই দেখে বাকি আমরা অর্থাৎ বাকি ব্যাঙের প্রজাতিগুলো ড্যাং ড্যাং করে নাচছি।
 
এখানে ঠ্যাং-এর মতো শব্দচয়ন দিয়ে তিনি সমাজের অশুভ প্রতীকগুলোর ওপর দুমদাম লাথি মেরেছেন। অর্থাৎ কবি তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজের অশুভ আত্মার ওপর পদাঘাত করেছেন। ঠ্যাংঠ্যাং করে মন্দিরে সন্ধ্যা আরতির ঘন্টাও বাজে। অর্থাৎ ঠ্যাং-এর মাধ্যমে তিনি সমাজের ধার্মিক এঙ্গেলটাও প্রতিফলিত করতে পেরেছেন। কবির মহান পঙক্তিতে সমাজ ও বিভিন্ন সামাজিক প্রসঙ্গ একসূত্রে বাঁধা পড়েছে। প্রতিটি পঙক্তি কেন ! প্রতিটি শব্দের জন্যে একটি করে পুরস্কার দেওয়া যেতে পারত। তাঁর অমর অক্ষয় সাহিত্যকীর্তি বাংলার পদ্যের বইয়ের মধ্যে ধ্রুবতারার মতো অমর অক্ষয় হয়ে থাকবে। কবির কাব্যিক ভাবনা যেমন সমাজকে নাড়া দেয় তেমনি পাদ্যের পাদ্যিকও পদ্যের মধ্যে একটা ভিন্ন স্বাদ ও গন্ধ দিয়ে মুক্তির জন্যে অস্থির করে তোলে।

দ্বিতীয় স্তবকঃ
'এপাং ওপাং ঝপাং
সুর ধরেছে পটাং 
ব্যাঙ ডাকে গ্যাং গ্যাং 
হাতির কতো বড় ঠ্যাং ।।'

দ্বিতীয় স্তবকে 'পটাং' নামের আরেকটি চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন কবি। পটাং সুর ধরেছে। এই শব্দবন্ধনীর মাধ্যমে কবি শান্তির বার্তা দিয়েছেন। ব্যাঙগুলো এবার গ্যাং গ্যাং করে ডেকে পটাং-এর সুরের স্বীকৃতি দিল। হাতি একটি অশুভ দমনকারী শক্তি। 'হাতির কত বড় ঠ্যাং' বলে কবি এইসব শক্তিসমূহকে তাচ্ছিল্য করেছেন। ব্যাঙের গ্যাংগ্যাং শুনেই হাতি ল্যাং খেয়ে গেছে। কবি ব্যাঙ-এর প্রতিবাদী সত্ত্বার মাধ্যমে সমাজের বর্তমান চালচিত্র তুলে ধরেছেন। এবং তিনি বলতে চেয়েছেন ব্যাঙগুলো যদি গ্যাংগ্যাং করে প্রতিবাদ করে তবে বুলডোজারের মতো হাতির ঠ্যাং-কেও ল্যাং মারা যায়।
কবি হাতি ও ব্যাঙ-এর সামাজিক সংঘাতকে পূঙ্খানুপূঙ্খ ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। কবির এই অমর সৃষ্টি বাংলা সাহিত্যকে অন্যান্য সাহিত্য থেকে পাঁচ গোলে এগিয়ে রাখতে পারল।
 
তৃতীয় স্তবকঃ
"এপাং ওপাং ঝপাং
পড়ে গিয়ে পটাং
বাঁচাও বলে ঝপাং
মুচকি হাসে এপাং ।।"

এখানে কবি পটাং-কে পড়ে যেতে দেখেছেন। যে কোন মহাকাব্যেই একটা করে ট্রাজেডি থাকে। পটাং-এর পড়ে যাওয়াও এই পদ্যের মধ্যে একটা ট্রাজেডি। তাই বাংলা সাহিত্যের পন্ডিত সমাজ এই পদ্যটিকে মহাকাব্যের বীজ বলেই আখ্যা দিয়েছেন। সুরের ঘায়ে কবি আমাদের মূর্ছিত করেছেন। একদিকে পটাং পড়ে রয়েছে। দাঁত কেলিয়ে। মানে দন্তবিকশিত করিয়া। পটাং সুর তুলতে পারছেনা। তার গলা থেকে গান বেরোচ্ছেনা। কেশে মরছে পটাং। এদের বুদ্ধির তার পটাং করে ছিঁড়ে গেছে। পটাং-রা চিৎপটাং হয়ে গেছে। পটাং-রা তৃণজীবি হয়ে গেছে। তার ওপর খুব লেগেছে পড়ে গিয়ে। মেরুদন্ড ভেঙে গেছে। ওদিকে বেগতিক দেখে মহাজাগতিক চরিত্র ঝপাং বাঁচাও বাঁচাও বলে প্রাণভিক্ষা করছে ঈশ্বরের কাছে। কেউ বাঁচাতে আসছেনা।
 
এইরকম ভয়াবহ পরিস্তিতির মধ্যে কবি ব্যাঙগুলোকে বাঁচিয়ে দিয়ে জনমানসে তাঁর মানবিক উৎকৃষ্টতা ফুটিয়ে তুলেছেন। কবির কাব্যের তৃতীয় স্তবকে তখন ব্যাঙ একটি প্রভাবহীন শারীরিক সত্ত্বা। অথচ ব্যাঙ তখন ব্রহ্মা। ব্যাঙই বিষ্ণু। ব্যাঙ তখন মহেশ্বর। অন্যদিকে পদির পদ্যে ব্যাঙ একটা পেঁচো মাতাল। ব্যাঙের চরিত্রটিকে মহাজাগতিকভাবে ফুটিয়ে তুলে আর ঝপাং-কে জাগতিক চারিত্রিক গন্ডিতে বেঁধে ফেলে তিনি আকাশ আর মহাকাশের যাবতীয় সুর ও ছন্দের অপূর্ব মিলনভূমি তৈরি করেছেন।