১৯৬৫ সালে পাকিস্তান একবার ভারত আক্রমণ করেছিল। সেই সময়ে দেশে খাদ্য সংকটও দেখা দিয়েছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ‘জয় জওয়ান, জয় কিসান’ স্লোগান দিয়ে একদিকে সেনাকে উৎসাহ দিচ্ছিলেন অন্যদিকে কৃষকদের জন্যেও বার্তা দিচ্ছিলেন যেন তাঁরা তাঁদের পরিশ্রম ও অধ্যাবসায় দিয়ে দেশকে খাদ্য সংকটের হাত থেকে বাঁচায়। সেই সংকটের সময়ে এই স্লোগানটা তুমুল জনসমর্থন পেয়েছিল। আজও এই স্লোগান মানুষ ভোলেনি। এবারের নির্বাচনে বিজেপি চেয়েছিল এই স্লোগানটা ফিরিয়ে আনতে। বিভিন্ন কারণে হয়ে ওঠেনি। ১৯৯৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পোখরানে পরমাণু বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে স্লোগান দেন ‘জয় জওয়ান, জয় কিসান, জয় বিজ্ঞান’। এরপর ২০০৯ সালে রাষ্ট্রপতির হাত থেকে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী পুরস্কার নেওয়ার সময়ে ডঃ কৈলাশ চন্দ্র মিশ্র স্লোগানটা আরও বর্ধিত করে বলেন ‘জয় জওয়ান, জয় কিসান, জয় বিজ্ঞান, জয় বিদ্বান’। তারপর এবছর মাস খানেক আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘বিদ্বান’ ছেঁটে স্লোগানটাকে আবার নতুন ভাবে বলেন। তিনি ১০৬তম বিজ্ঞান কংগ্রেসের মঞ্চ থেকে স্লোগান দেন ‘জয় জওয়ান, জয় কিসান, জয় বিজ্ঞান, জয় অনুসন্ধান’।

স্লোগান যুদ্ধ যুগে যুগে বিদ্যমান। ১৯৬০ সালে কংগ্রেস স্লোগান দিল, ‘প্রোগ্রেস থ্রু কংগ্রেস’। শিবসেনা তখন এই স্লোগানের বিরুদ্ধে তৈরি করল ‘কংগ্রেস অর প্রোগ্রেস?’ স্লোগান। যার অর্থ দাঁড়াল কংগ্রেস চাই, না উন্নতি চাই? 

গোরু বাছুর নিয়ে এখন লাফালাফি অনেক হয়। ‘ইন্দিরা কংগ্রেস’ গঠনের পর ঐ পার্টির চিহ্ন ছিল গোরু-বাছুর। ভোটের সময়ে একটা স্লোগান তৈরি হয় – ‘ভোট ফর কাফ অ্যান্ড কাউ, ফরগেট অল আদার্স নাউ’। কিন্তু পরবর্তী কালে গোরু বাছুরকে বিরোধীরা ইন্দিরা আর সঞ্জয়-এর সঙ্গে তুলনা টেনে এই চিহ্নটাই ফ্লপ করিয়ে দেয়। পরে সামাল দিতে না পেরে চিহ্নটাই পালটে ফেলা হয়। ইন্দিরা গান্ধীর আমলে অনেক অনেক স্লোগান তৈরি হয়। ১৯৭১ সালে তৈরি হয় ‘গরীবি হাটাও, ইন্দিরা লাও, দেশ বাচাও’। জয়প্রকাশ নারায়ণ তখন জনতা পার্টির হয়ে স্লোগান তোলেন, ‘ইন্দিরা হাটাও দেশ বাচাও’। ১৯৭১-এর নির্বাচনে ‘গরীবি হাটাও’ স্লোগানটা কাজ করেছিল ইন্দিরার পক্ষে। ‘হাটাও’ আর ‘বাঁচাও’ নিয়ে সবসময়েই স্লোগান তৈরি হচ্ছে। 

দেশে ইন্দিরা হাওয়া অনেকদিন ছিল। বিরোধীরা ইন্দিরা আমলের চিনি আর কেরোসিন তেলের অভাব নিয়ে স্লোগান তৈরি করেছিল, ‘য়ে দেখো ইন্দিরা কা খেল, খা গঈ শক্কর, পী গঈ তেল’। অর্থাৎ, দেখুন ইন্দিরা গান্ধীর কেরামতি, তিনি চিনি আর তেল হজম করে ফেলেছেন। তার দেখাদেখি ইন্দিরা গান্ধীও পালটা স্লোগান তৈরি করে চাউড় করেন, ‘আধি রোটি খায়েঙ্গে। ইন্দিরা কো জিতায়েঙ্গে’। এই স্লোগানের নকল এখনও শোনা যায় – ‘আধি রোটি খায়েঙ্গে, মন্দির ওঁহি বানায়েঙ্গে’। 

ইন্দিরার নামে একটা আরেকটা স্লোগান তৈরি হয়েছিল তাঁর প্রয়াত হওয়ার পর। তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। এতে তাঁর জনপ্রিয়তা বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। কংগ্রেস সুযোগ বুঝে একটা স্লোগান বানিয়েছিল, ‘জব তক সুরজ চাঁদ রহেগা, ইন্দিরা তেরা নাম রহেগা’। সহানুভূতি ভোট সেবার কংগ্রেসেই এল। ১৯৮৪ কংগ্রেস শুধুমাত্র এই স্লোগানের ওপর নির্ভর করে বাকি সব দলকেই গোহারান হারিয়ে দিল। এখনও এই স্লোগানটা খুব শোনা যায়। ‘ইন্দিরা’র বদলে ‘পচা’ বা ‘ভজা’ যার তার নাম বসিয়ে এই স্লোগানটা এখনও খুব খায় মানুষ। প্রায় সব দলই এই স্লোগানটা ব্যবহার করে বারবার। 

জাতপাত ও ধর্ম নিয়েও স্লোগান তৈরি হয়েছে। নির্বাচনে ধর্ম ভাগ করে ভোট কুড়োতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ স্লোগান তৈরি করেছিল, ‘বাচ্চা বাচ্চা রাম কা, জনমভূমি কে কাম কা’। ‘সৌগন্ধ রাম কি খাতে হ্যাঁয়, মন্দির ওঁহি বানায়েঙ্গে’। উত্তরপ্রদেশ সহ গোবলয়ে ভোট ভাগ করতে এই দুটো স্লোগান এখন খুব পপুলার। স্লোগানের এই জনপ্রিয়তা আটকাতে মুলায়ম সিং ও কাঁসিরামের স্লোগান ছিল ‘মিলে মুলায়ম-কাঁসিরাম, হাওয়া হো গয়ে জয় শ্রীরাম’। এগুলো সব বাবরি মসজিদ ভেঙে দেওয়ার পরবর্তী কালের স্লোগান। জাতপাতের রাজনেতারা ধাপে ধাপে ভারতীয় রাজনীতিতে নিজেদের কলেবর বৃদ্ধি করে ফেলার পর, ১৯৯৬ সালে, নরসিমহা রাও কংগ্রেসের তরফ থেকে আরেকটা স্লোগান দেন – ‘না জাত পর, না পাত পর, মুহর লগেগি হাত পর’। অর্থাৎ, জাতপাতে নয়, হাত চিহ্নেই ভোট দাও। এই স্লোগানটা কবি শ্রীকান্ত বার্মা ইন্দিরা গান্ধীর জন্যে তৈরি করেছিলেন – ‘না জাত পর, না পাত পর, ইন্দিরাজি কে বাত পর, মুহর লগেই হাথ পর’। 

গোবলয়ে যতরকম স্লোগান জনপ্রিয় হয়েছে, তার মধ্যে লালু যাদবের স্লোগানটা কেউ ভুলতে পারবেনা, ‘জব তক রহেগা সমোসা মে আলু, তব তক রহেগা বিহার মে লালু’। আরেকটা মজার স্লোগান দেওয়া হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীর আমলে। চিকমাগালুরের নির্বাচনে স্লোগান তৈরি হয়, ‘এক শেরনি, শ’ লঙ্গুর, চিকমাগালুর, চিকমাগালুর,। এখানে ‘শেরনি’ অর্থাৎ সিংহী মানে ইন্দিরা ও একশ হনুমান মানে বাকি বিরোধীরা। ১৯৭৭ সালে ইন্দিরার বিরুদ্ধে স্লোগান ওঠে, ‘সঞ্জয় কি মম্মি, বড়ি নিকম্মি’, অর্থাৎ সঞ্জয় গান্ধীর মা নেহাৎ অকম্মা। 

‘জনসঙ্ঘ কো ভোট দো, বিড়ি পিনা ছোড় দো। বিড়ি মে তাম্বাকু হ্যায়, কংগ্রেসওয়ালা ডাকু হ্যায়’। এইটা ছিল জনসঙ্ঘের প্রথম কংগ্রেস বিরোধি স্লোগান। কংগ্রেসের পড়ন্ত বেলায় বিজেপির অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের স্লোগান ছিল, ‘বারি বারি সব কি পারি, আব কি বারি, অটল বিহারী’। অর্থাৎ বার বার তো সবাইকে ভোট দিলে এবার অটল বিহারীকে ভোট দাও। এই নির্বাচনে অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে মাত্র ১৩ দিন সরকার টিকেছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপির আচ্ছে দিন দেখতে স্লোগান উঠেছিল, ‘আব কি বার মোদী সরকার’। তার সঙ্গে ধর্মের মশলা দিয়ে স্লোগান তৈরি হয়েছিল, ‘হর হর মোদী, ঘর ঘর মোদি’। এই দুটো স্লোগান খুব পপুলার হয়েছিল। 

নির্বাচন এলে স্লোগান আর কিছু শব্দের ব্যবহার খুব বেড়ে যায়। এই নির্বাচনে কয়েকদিন ধরে ‘মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’ স্লোগানটা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মতো শক্তি পাওয়ার আগেই ‘ম্যায় ভি চৌকিদার’ স্লোগানটা এবার ভারতের নির্বাচন মঞ্চে ফিট হয়ে গেছে। বলা যায় হিট হয়ে গেছে। এর পেছনে বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ কংগ্রেস বা রাহুল গান্ধী দায়ী। নরেন্দ্র মোদি নিজেকে চৌকিদার বলছেন শুনে রাহুল গান্ধী বলতে শুরু করলেন ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’। তারপর উনি ভাষণ দিতে মঞ্চে উঠেই ভাষণ দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে মঞ্চ থেকেই আওয়াজ দিতে শুরু করলেন ‘চৌকিদার’। তারপর আঙুল তাক করলেন শ্রোতা ও সমর্থকদের দিকে। আওয়াজ উঠল ‘চোর হ্যায়’। এই ব্যাপারটা যখন জমে উঠেছে ঠিক তখনই এসে গেল ‘ম্যায় ভি চৌকিদার’ স্লোগান। 

স্লোগান সর্বস্ব এই রাজনৈতিক ভারতে মানুষের লাভের লাভ কিছু হয়নি। দারিদ্র্য সারেনি। কৃষকদের হাল বেহাল। জওয়ানদের অবস্থাও স্থিতিশীল নয়। অবসরপ্রাপ্ত ‘জওয়ান’দের তো নিজেদের পেনশন ভিক্ষা করতে হয়। শুধু একটা কথাই সত্যি ফলে গেছে। ‘আধি রোটি’ আর এক ঘটি জল খেয়ে পেট ভরাচ্ছে দেশের অগুনতি মানুষ। কে যে চোর আর কেই বা চৌকিদার সব গুলিয়ে যাচ্ছে।