কে কি খাবে বা কে কাকে খাবে এসবের পেছনে আছে বিজ্ঞান। তাকে বলে খাদ্যশৃঙ্খলা। খাদ্যশৃঙ্খলায় সবচেয়ে ছোট জীবকে তার চেয়ে বড় জীব খেয়ে বেঁচে থাকে। আর এই ভাবেই চলতে থাকে। তবে হরিণ তার চেয়ে ছোট জীব খরগোশ মেরে কোনদিন খেতে পারেনি। কিংবা মোষ, যা কিনা বাঘের চেয়ে আকারে বড়, কোনদিন বাঘ মেরে খায়নি। দুর্বলকে সবলে সদলবলে খেয়ে ফেলে। এইটাই হল বিশ্বসত্যি। হরিণ ঘাসের চেয়ে বলশালী। তাই হরিণ ঘাস খায়। আর বাঘ মোষের চেয়ে ক্ষিপ্র ও হিংস্র এবং প্রবল শক্তিধারী। তাই মোষ বাঘের খপ্পরে পড়লে বাঘ মোষকে খেয়ে নেয়।

বলা হয় খাদ্যশৃঙ্খলাটি স্বয়ং ব্রহ্মার তৈরি। একবার ব্রহ্মার আদেশে ভগবান রূদ্র পৃথিবীতে প্রজা বা প্রাণী সৃষ্টির চাকরি পেয়েছিলেন। কিন্তু প্রাণীরা জন্মে খাবে কি? বাঁচবে কি করে? তাই রূদ্র অনেক ভেবে মনস্থির করলেন আগে প্রাণীর খাদ্য তৈরি করতে হবে। এইবার হল সমস্যা। তত্ত্বের দিক থেকে তো সঠিক হওয়া গেল। গোল বাধল প্রয়োগ নিয়ে। খাদ্য কি করে তৈরি হবে! ভগবান রূদ্র এই সমস্যার সঠিক সমাধানের জন্যে জলের মধ্যে ঢুকে তপস্যা বা গবেষণা শুরু করলেন। খাদ্য সৃষ্টি না করে শুধুই প্রয়াণ সৃষ্টি করে গেলে পৃথিবীতে অরাজকতা শুরু হয়ে যাবে। খাদ্য না পেলে নতুন সৃষ্ট প্রাণও বিনষ্ট হয়ে যাবে। বছরের পর বছর কেটে যাচ্ছে। রূদ্রের গবেষণা তখনও শেষ হয়নি। তিনি জলের তলাতেই বসে আছেন। অন্যদিকে ব্রহ্মা অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন। এতদিন কেটে গেল, রুদ্রবাবু গেলেন কোথায়! এখনও তিনি প্রাণ সৃষ্টি করতে পারলেন না! এ কেমন লোককে আমি চাকরি দিলাম! অন্যজনকে ডাকলেন ব্রহ্মা।

এবার এলেন রুদ্রের ছোটভাই অমর। ব্রহ্মা তাঁকেও প্রজা সৃষ্টি করার চাকরি দিলেন। চাকরি পেয়ে অমর মহানন্দে প্রজা সৃষ্টি করতে শুরু করলেন। যা পারছেন তাই তৈরি করছেন। মানুষ, হনুমান, হরিণ, জিরাফ, গিরগিটি, কুমীর, সাপ, বেজি, ব্যাঙ, আরশোলা, মশা, মাছি, বাজপাখি, পায়রা, বাঘ, ভাল্লুক, কাক, টিয়া, চড়ুই, পোকামাকড়। জঙ্গল, পাহাড়, নদী ও সমুদ্র আগে থেকেই ব্রহ্মার অনুমতি পেয়ে অন্যান্য অনেকে বহুদিন ধরে তৈরি করেছিলেন। ভাই অমর অবিরাম প্রজা সৃষ্টি করে যাচ্ছেন। কিন্তু প্রজাদের খাদ্য তৈরি করছেন না। ওদিকে ক্ষিদের জ্বালায় প্রজারা অস্থির। কে কি খাবে তাই জানে না। নতুনরা রেগেমেগে সবাই মিলে সৃষ্টিকর্তা অমরকেই খাবে বলে তাড়া করল। এ এক নতুন জ্বালা। কাজ করতে গেলে সমস্যা হবেই। সমাধানের জন্যে অমর দৌড়োলেন ব্রহ্মার কাছে। আমাকে বাঁচার প্রভু। আমি এক মস্ত ভুল করে ফেলেছি। আপনার আদেশপ্রাপ্ত হয়ে আমি প্রচুর প্রচুর প্রাণ সৃষ্টি করে চলেছি। কিন্তু তাদের জন্যে খাদ্য তৈরি করতে পারিনি। এইবার আপনি বলুন, এই লক্ষ লক্ষ প্রাণসমুদায় খাবে কি? নতুনরা অমরকে তাড়া করে খেতে এলেও অমর এদের কোন ভুল দেখতে পেলেন না। ওদের কি দোষ প্রভু! আমার দাদা রূদ্র তো এই নিয়েই গবেষণা করছেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এইরকম কোন কেলোর কীর্তি হতে পারে। তাই তিনি আগে প্রাণ সৃষ্টি করার ঝুঁকি নিতে চাননি। আপনি অধৈর্য্য হয়েছেন দেখে আমি এই কাজটা করে ফেলতে চাইলাম। কিন্তু এখন বিপত্তি এসে গেছে। আপনি বাঁচান। একটা লিস্ট বানিয়ে দিন স্যার। আমি সেই ফর্দটা নতুনদের সকলকে পড়ে শুনিয়ে দেব। তাহলে ওদের আর কোন সমস্যা থাকবেনা।

ব্রহ্মা ছিলেন অন্য কাজে ব্যস্ত। তাঁর হাতে সময় কম। অথচ তাঁর কথা শুনতে গিয়ে তাড়াহুড়ো করে অমর বিপত্তি ডেকে এনেছেন। এই চিন্তা তাঁর কপালে ভাঁজ ফেলল। তিনি চটজলদি চিন্তা করে বলে দিলেন, অত হ্যাপা সামলানোর কি আছে বাপু, ওদের বলে দাও যে যাকে পারে ধরে খাক। যে পারবে সেই বেঁচে থাকবে। যে পারবে না সে মরে যাক। আর তুমি বাপু প্রাণসৃষ্টি করা ছেড়ো না। তুমি অনবরত প্রাণসৃষ্টি করে যাও। অমর ব্রহ্মার কাছ থেকে বুদ্ধি পেয়ে নতুনদের তাই শুনিয়ে দিলেন। নতুনরা তাই করতে শুরু করল। যে যাকে পারল খেতে শুরু করল। কেউ কেউ দৌড়ে জঙ্গলে পালাল। কেউ গাছে চড়ল। কেউ গর্তে ঢুকল। কেই উড়তে শুরু করল। যাদের মাংসভক্ষণে রুচি ছিলনা তারা ঘাসপাতা, ফলপাকুড় খেতে শুরু করল। বাঘ আমিষ ভক্ষণ করতে শুরু করল। হরিণের ভাল লাগল নিরামিষ। বেজি সাপ খেল। বাজে খেল পায়রা। মানুষের সব কিছুই ভাল লাগে। তাই তারা সর্বভূক হয়ে গেল।

রুদ্র ততদিনে গবেষণা করে তাঁর তেজদ্বারা ধীরে ধীরে খাদ্য সৃষ্টি করতে শুরু করেছেন। তাঁর তেজে সমস্ত প্রাণীই শক্তি আহরণ করে উত্তরোত্তর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হল। তিনি তেজদ্বারা ঘাসপাতা, গাছপালাকে সবুজ করে রাখলেন। সবুজ খাদ্য খেয়ে অমরসৃষ্ট নতুন নতুন প্রাণের কিয়দাংশ অন্যান্য জীবের খাদ্য হিসেবে চিহ্নিত হল। রূদ্র তেজদ্বারা নদী, সমুদ্রের জল আকাশে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে দরকার মতো জায়গায় জায়গায় ফেলতে লাগলেন। এরফলে নিত্যনতুন প্রাণীখাদ্য তৈরি হতে শুরু করল। এইভাবেই খাদ্যশৃঙ্খলার সৃষ্টি হল।

তবে ব্রহ্মা যদি অতিষ্ঠ না হয়ে রূদ্রের জন্যে অপেক্ষা করতেন মনে হয় পৃথিবীটা অন্যরকমের হত। মাঝখান থেকে অমর এসে অরাজকতা তৈরি করে সমাধান না পেয়ে ব্রহ্মার বুদ্ধি খাটিয়েছিলেন বলে এখনও সেই ধারা বর্তমান।