আজ হুল দিবস। ১৮৫৫ সালের এই দিনে সিদো, কানহো’র নেতৃত্বে অধুনা ঝাড়খন্ড রাজ্যের সাহেবগঞ্জ জেলার ভগনাডিহ গ্রামের ইংরেজ ও ইংরেজ সমর্থিত জমিদারদের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ শুরু হয়। অনুমান করা হয় এই বিদ্রোহ দমন করতে ইংরেজরা ২০ হাজার আদিবাসীকে নির্বিচারে হত্যা করেছিল। এই বিদ্রোহের নাম হুল বিদ্রোহ বা সাঁওতাল বিদ্রোহ।

সাঁওতাল পরগণা তখন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির আওতায় ছিল। পাহাড় ও জঙ্গল ঘেরা এই এলাকায় সাঁওতাল, মালপাহাড়িয়া ও অন্যান্য আদিবাসীরা এখানে কৃষিকার্য করে জীবন যাপন করত। তাছাড়া জঙ্গলে উৎপন্ন বিভিন্ন পণ্য তারা বিক্রি করত আর শিকার করত। সদ্য রেল লাইন পাতার কাজ শুরু হয়েছে তখন সেই অঞ্চলে। এই অঞ্চলের সাঁওতালরা রেল লাইন পাতার কাজে শ্রমিকের কাজও করতে শুরু করেছে।

এই সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজস্ব বাড়ানোর অভিপ্রায়ে স্থানীয় জমিদারদের মাধ্যমে পল্টন তৈরি করে এই অঞ্চলের আদিবাসীদের কাছ থেকে কর আদায় করার কাজে জোর দেয়। এর আগে পর্যন্ত আদিবাসীরা কাউকে কর দিতনা। সরকারি নিয়মে বাধ্য হয়ে খাজনা মেটাবার জন্যে আদিবাসীরা নিরুপায় হয়ে সুদখোর মহাজনদের দ্বারস্থ হত। টাকা ধার করতে হত। টাকা ফেরত দিতে অক্ষম আদিবাসীদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সুদখোর মহাজনরা তাদের জমির অংশে ভাগ বসাতে শুরু করল। এবং অন্যান্য অত্যাচার শুরু হল। অসন্তোষ শুরু হল আদিবাসীদের মধ্যে। এই অসন্তোষ বিদ্রোহের রূপ নিল।

প্রায় চারশো গ্রামের ৫০ হাজার আদিবাসী ১৮৫৫ সালের আজকের দিনে ভগনাডিহ গ্রামে একত্রিত হয়ে একটি সভা করে। সভা থেকে ঘোষণা করা হয় যে তারা আর ইংরেজদের বা ইংরেজ সমর্থিত জমিদারদের জমির খাজনা দেবেনা। বিদ্রোহের এইভাবেই শুরু। এরপর ইংরেজ বাসিন্দা দেখলেই অঞ্চল থেকে খেদানো শুরু হয়। সরকারি পুলিশ খেদানো শুরু হয়। জমিদারদেরও এলাকা থেকে তাড়িয়ে দিতে শুরু করে বিদ্রোহীরা। ইংরেজরা এলাকা ছাড়া হয়।

এই ধরণের পরিস্থিতি দেখে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চটে যায়। সিদো, কানহোকে পুলিশ গ্রেফতার করতে গেলে ৭ জুলাই ১৯৫৫ সালে নয় জন পুলিশকে বিদ্রোহীরা গলা কেটে হত্যা করে। সরকারি ইংরেজ কর্মচারী দেখলেই তীর ছুঁড়ে তাড়ানো শুরু হয়। ধরা পড়ে গেলে হত্যাও করা হতে থাকে। এর ফলে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে ভয় সৃষ্টি হয়। বেগতিক দেখে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্যারাকপুর থেকে সেনাবাহিনী আনিয়ে আদিবাসী বিদ্রোহ দমন করার কাজে লাগায়। তারপর শুরু হয় বন্দুকধারী সেনাবাহিনীর অকথ্য অত্যাচার ও দমন পীড়ন। গুলি করে হত্যা করা হতে থাকে আদিবাসীদের। 

ইংরেজদের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের এই স্বাধীনতা সংগ্রামে ২০ হাজার আদিবাসী শহীদ হন। যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হন চাঁদ ও ভৈরব। কিছু অসৎ ও বিশ্বাসঘাতক আদিবাসী পয়সার লোভে পড়ে সৈন্যদের কাছে খবর পাচার করে সিদো ও কানহোকে ইংরেজদের হাতে তুলে দেয়। বিনা বিচারে ও জন সমক্ষে ভগনাডিহ গ্রামেই একটা গাছে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেওয়া হয়। হুল বিদ্রোহ এই ভাবেই দমন করা হয়।

বিখ্যাত ইংরেজ ঐতিহাসিক W. W. Hunter-এর বই “অ্যানালস অফ রুরাল বেঙ্গল’-এ এর খানিকটা বর্ণনা পাওয়া যায়।