করতে হবে। লড়তে হবে। পারলে মরতেও হবে! এইসব রক্ত গরম করা কথা এখন সিপিএম দলের নেতাদের বক্তামিতে শোনা যাচ্ছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের নীতি নিয়ে এখন আর জনসমক্ষে সুবিশাল আলোচনা চলছেনা। মুদ্রাস্ফীতি আর কর্মী ছাঁটাই নিয়ে বিশ্বায়নের ধুয়ো তুলে নিজেদের দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলার কৌশল ভুলে এখন শুধুই এক বার্তা – মানুষের বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। শাসক দলের সন্ত্রাসের মোকাবিলা করতে হবে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। হতে পারে রাজনৈতিক লড়াইয়ের সঙ্গে সঙ্গে দু চার রদ্দা শাসক দলের দুষ্কৃতীদের পিঠেও কষাতে হবে। পুলিশকে ভয় করলে আর চলবেনা। শাসক দলের পুলিশ শাসকদের ঝোল টেনে কাজ করবে। তাই এখন পুলিশকে শাসকের কাঠপুতুল বলে কর্মীদের সান্ত্বনা না দিয়ে পুলিশের অন্যায়ের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হতে হবে। হতেই হবে। কর্মীরা আক্রান্ত হলে তাবড় নেতাদের দৌড়োতে হবে। মানুষ বিপন্ন হলে পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র অনুশাসিত ও সংগঠিত শক্তি সিপিএমকেই মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। আমাদের তো ভোট দিলিনি, এখন দ্যাখ কেমন লাগে বলে মস্করা করলে চলবে কি?

৮ই মার্চ বিগ্রেডে সেই বার্তা দিয়ে এসেছেন নেতারা। কিন্তু তাতে কি দলের কর্মীদের মনোবল বেড়েছে? এক অজ গ্রাম যেখানে মোটামুটি ৬০০ পরিবার বাস করে সেখান থেকে জনা তিরিশেক লোক নিয়ে ১৭০ কিমি রাস্তা ঠেঙিয়ে কোলকাতা এসে এইসব বক্তৃতা শোনা কয়েকজন লোককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কোলকাতা গিয়ে কি পেলেন। একজন তো বলেই বসলেন তিনি রাস্তা থেকে দশ টাকার একটা নোট কুড়িয়ে পেয়েছেন। অন্য আরেকজন বললেন তিনি কিছুই পাননি। তাঁর ভাগ্য খারাপ। আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম কোলকাতার দলীয় সভায় কে কি বললেন! একজন বললেন তিনি কিছুই বলেননি। তিনি শুনেছেন। আমি চটজলদি জিজ্ঞাসা করলাম তিনি কি শুনেছেন? তিনি বললেন এবারে বিজেপির সঙ্গে মোকাবিলা হবে। তৃণমূল ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাচ্ছে।

ধুত্তোর। এইসব লোক নিয়ে লাল পতাকা ধরিয়ে দিয়ে সারা মাঠ লালে লাল করে ছবি তুলে সেই ছবি নিজেদের খবরের কাগজে ফলাও করে ছেপে লাভ হল কি? অনেক তাত্ত্বিক বলবেন, আলবৎ লাভ হয়েছে। অনেক মানুষ কাগজের ছবি দেখেই বুঝবে এখনো অনেক মানুষ তাঁদের সঙ্গে আছেন। কিন্তু আমি যে অজগ্রামের কথা বললাম সেই গ্রামের কেউ কোনদিন খবর কাগজ কেনার বিলাসিতা করেননা। কারণ অধিকাংশই নিরক্ষর! তাহলে এই গ্রাম থেকে জনাতিরিশেক লোক ধরে ব্রিগেডে নিয়ে গিয়ে কি লাভ হল? অন্য যে কোন রাজনৈতিক দলই এই লোক টানাটানির কাজ করেন। দেখা যায় সেই জনাতিরিশেক লোকই আবার বিজেপির জনসভায় যাচ্ছেন। তৃণমূলের জনসভাতেও যাচ্ছেন। তাঁরা সারদা বোঝেননা। তাঁরা গণতন্ত্র যে কিসের মোয়া তাও জানেননা। তাঁরা রাজ্যের দৈনন্দিন হালহকিকত নিয়েও মাথা ঘামাননা। তাঁরা রাণাঘাট, কামদুনি, মধ্যমগ্রাম কান্ড শোনেননি! তাঁরা নিজেদের জমিতে ধান, পাট, বেগুন, কলা, মুলো ছাড়া আর কিছুই বুঝতে চাননা। বোঝাতে গেলে শুনতে হয়, ওসব বুঝে কি হবে? পেটের ভাত জুটবে! কে বোঝাবে ওদের পেটের ভাত কি করে জোটে। কেন জোটে? কেন জোটেনা?

আমার এই কথা বলার একটা উদ্দেশ্য আছে। সিপিএমের এইসব দলীয় কর্মযজ্ঞ বিশেষ করে জনসভা করে প্রত্যন্ত গ্রামের গ্রামীণ মানুষের কাছে পৌঁছোন যায়না। তাঁরা যা বোঝেননা তাই তাঁরা শুনতে যাচ্ছেন। তাঁরা যা বোঝেন তা তাঁরা শুনতে পাচ্ছেন না। এইখানেই আক্ষেপ। ওই জনাতিরিশেক লোক যদি সেদিন গ্রামেই একটা মিছিল করতেন এবং একজন দুজন গ্রামের লোকদের তাঁদের সমস্যা নিয়ে কথা বলতেন তবে হয়তো ব্রিগেডে তিরিশজন লোক কমে যেত কিন্তু গ্রামের লোককে বোঝানো যেত। কিন্তু করবেটা কে? সেখানেও তো ভয়। শাসকদলের কর্মীরাও তো সেই গ্রামে আছেন। তাঁদের হাতে এখন ক্ষমতা আছে। যদি আক্রমণ হয় তবে বাঁচাবে কে?

আসন্ন পৌরসভা নির্বাচন উপলক্ষ্যে সিপিএমের ‘জানকবুল’ লড়াইয়ের বার্তা যেন ধুনোর গন্ধ। ধোঁয়া শেষ হলে গন্ধও শেষ। বিজেপি দলের মনোনয়ন প্রার্থীদের মধ্যে জেলায় জেলায় মারামারি, লাঠালাঠি। তৃণমূলের আমলের দুর্নীতির আলোচনা করে আত্মসন্তুষ্টির জায়গা নেই। তৃণমূলের গোষ্ঠীকোন্দল কিন্তু শাসক দলের দুর্বলতা নয়। একমাত্র মাথা যখন মমতা তখন যে কোন গোষ্ঠীর কাছেই শেষ কথা মমতা। এই কথাটি ভুলে গেলে হবে কি করে?

এখন করতে হবে। তবে না করলেও হবে। কারণ মানুষকে তো বোঝানো যাবে, দ্যাখ ক্যামন লাগে! এখন লড়তে হবে। না লড়লেও হবে। কারণ অনেকদিন মানে সেই শাসকদলে দীর্ঘকালীন টিকে থাকার ফলে লড়াইয়ের ময়দানে আর কেউ লড়তে নামেনা। অনেককে পাইয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেকে না লড়াই করেই অনেক কিছু পেয়েছেন। তাই মানুষ লড়তেই ভুলে গেছেন। তবে মরতে হতে পারে। ক্ষমতা হারানোর পর কিন্তু মৃত্যুমিছিল বেড়েছে। সান্ত্বনা দেওয়ার লোক খুঁজে পাওয়া যায়না। সাহায্য তো দূর অস্ত। পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফল ভাল হলেই ভাল। বোঝা যেতে পারে মানুষ আবার নিজেই নিজেই সিপিএম বা বামফ্রন্টকে চাইছেন। এই নির্বাচনের ফল মন্দ হলে আরও ভাল। বেনোজল শুকোনোর সময় দিতে হবে তো। তখন হয়তো সিপিএম বা বকলমে বামফ্রন্ট নিজে নিজেই মানুষের দিকে চাইবে। 

আসল বামপন্থীরা আবার নিজেদের আত্মসমীক্ষা করে হয়তো ‘করতে হবে’ ‘লড়তে হবে’ না বলে চুপচাপ নিজেরাই করে নেবেন। লড়ে নেবেন। বামসমর্থক মানুষ হয়তো স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই রাস্তায় নামলেন। যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধেই সোচ্চার হয়ে মানুষ হয়তো বামকর্মীদেরই পাশে দাঁড়ালেন। আবার মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়ার সুযোগ যখন এসেছে তখন মানুষ থেকে বিমুখ হয়ে থাকলে চলবেনা। মানুষের মাঝে দাম্ভিকতার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে আবার মিশে যেতে পারলেই হয়তো হবে।