হালকা কাঠ, পাতলা টিনের পাত ইত্যাদি দিয়ে একটা খেলনা বিমান বানিয়ে ১৯০৩ সালে রাইট ভাইয়েরা তাতে পেট্রোল ইঞ্জিন যুক্ত করলেন। বাড়িতে বানানো ইঞ্জিন। বিমানে এক ডানায় ইঞ্জিনটা বেঁধে দেওয়া হল। অন্য ডানায় দুই ভাই নিজেদের বেঁধে ফেললেন। ইঞ্জিন স্টার্ট হল। বিমান ওড়ানোর প্রথম পদক্ষেপ। বলা হয় আধুনিক বিজ্ঞানে মানুষ ওইদিন থেকেই উড়তে শিখেছে। ওড়ার কাহিনী ওইদিন থেকেই শুরু হয়েছিল। তারপর মানুষ নিত্য নতুন আবিষ্কার করে চলেছেন। বিমানও অনেক শক্তিশালী হয়েছে। শুধু বিমান কেন, অন্তরীক্ষগামী যানও পৃথিবীতে তৈরি হয়েছে এই সব প্রয়োগের ওপর ভরসা করে। তাও এখনো অন্তরীক্ষের দূরত্ব বিজ্ঞানীরা হাতের মুঠোয় আঁটিয়ে উঠতে পারেননি।

পৌরাণিক গল্পে ও মহাকাব্যে কিন্তু আমরা এই সব বিমানে চড়ে যাতায়াত করার গল্প কয়েক হাজার বছর আগে থেকেই পড়ে আসছি। কখনো দেবতা, কখনো রাজা, কখনো আবার ঋষি মুনিদের বিমানে চেপে ঘুরতে দেখা গেছে। যুদ্ধ বিমানও ছিল। ছিলেন বিমান নির্মাণকারী। তখনকার ওই তালপাতায় লেখা কবিদের কাছে এইরকম যে অবাস্তব কল্পনার অভাব ছিলনা। কবিরা যা দেখতেন তাই লিখতেন। শ্রুতি গল্প ও শ্রুতি কবিতার তো তেমনি ভাবেই উৎপত্তি। আমি যা দেখলাম তা আপনাকে বললাম। আপনি আবার অন্য একজনকে শোনালেন। রঙ চড়িয়েই শোনালেন ধরে নিলাম। এইভাবেই গল্প এগিয়ে চলল। কিন্তু কোনভাবেই একটা বিশেষ সীমা পার করেনা। অর্থাৎ আমাদের কল্পনা বহির্ভূত কোন কিছু এই গল্পের মধ্যে ঢোকানো যায়নি। 

পৌরাণিক কবিরা বিমানকে কখনো রথ বলেছেন। কখনো সরাসরি বিমানও বলেছেন। উড্ডীন শহরকে কখনো বলেছেন সভা। আবার কখনো ফুল বলেছেন। পৌরাণিক কবিরাই ছিলেন ইতিহাসবেত্তা। প্রাগৈতিহাসিক জীবনের ধারা বিবরণী আমরা ওই সব কবিদের রচনাতেই উপলব্ধি করি। আমরা জানি যে তখন বিশেষ বিশেষ জনপদের নাগরিক নিজেদের মধ্যে শক্তিশালী কাউকে রাজা ঘোষণা করতেন। এইভাবেই তাঁরা সমাজ প্রতিষ্ঠা করতেন। সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্যে তাঁরাও যুদ্ধ করতেন। এক জনপদ অন্য জনপদের ওপর চড়াও হত। বিজয়ীকে রাজা বলা হত। কিংবা দীর্ঘকাল ধরে বংশপরম্পরায় কোন অঞ্চলে যাদের রাজত্ব চলত তাঁদেরও রাজা বলা হত।

তখনকার রাজারা যে রথে চেপে যুদ্ধ করতেন তা যে সমসময়েই কাঠের হত কিংবা সব রথকেই যে ঘোড়ায় টানত তা বলা যাবেন। বর্ণনাতে রয়েছে এরকম অনেক রথের কথা যা আগুন ছড়াত। কাঠ যদি আগুন ছড়ায় তো আগে কাঠের রথই পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। তাই রথ মানেই যে কাঠের তৈরি তা চিন্তা করাই ভুল। 

পৌরাণিক কবিদের কল্পনার বলিহারি! আদতে যুদ্ধ হত ডাণ্ডা, কুড়ুল, কোদাল, বল্লম, তরোয়াল ইত্যাদি দিয়ে। ভিড়ভাড়ের মধ্যে মারামারি, কাটাকাটি। মোটামুটি মারদাঙ্গার মতো একটা ব্যাপার। কিন্তু কবিরা লিখেছেন বিমানে চেপে মানুষ যুদ্ধ করত। আকাশ থেকে অগ্নিশর বর্ষণ হত। বিজ্ঞানের যুগে মাত্র একশো বছর আগে আমরা বুঝতে শিখেছি যে ওড়াও যায়। অথচ সেকালের কবিরা তো এই বাস্তবকে হাজার হাজার বছর আগেই কল্পনা করে ফেলেছিলেন। এরকম দুঃসাহসিক কল্পনার কথা আবার বিশদভাবে ব্যাখ্যা দিয়ে কাব্যরচনা আমরা পৌরাণিক গল্পে দেখতে পাই।

তাঁরা কি বলেছিলেন শুধু দেবতারাই বিমানে যাতায়াত করতে সক্ষম! তা নয়। বিমান বলতে তাঁরা কি গরুড়ের মতো কোন পাখিকে ভেবেছিলেন! তাও নয়। সব কিছুই যদি বুজরুকি বলে ধরে নেওয়া যায় তাহলে আর কোন কথা থাকেনা। এখনকার আমলের প্রেক্ষাপটে ব্যাখ্যা করে বোঝা যাবে আসলে কেউই কেউ নয়। ওসব স্রেফ বুজরুকি। স্রেফ গাঁজাখুরি। কবিরা গাধার পিঠে চড়ে এ গ্রাম থেকে ও গ্রাম ঘুরে চারণ গান গেয়ে বেড়াতেন। গান গাইতেন আর ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। আর ভাবতেন বুঝি বিমানে চেপে দেবরাজ ইন্দ্র চলেছেন তাঁদের সামনে সামনে। বলা যায় বেশি ভিক্ষা পাওয়ার লোভে সেই সব কবিরা যখন তখন যাকে তাকে বিমানে চাপিয়ে দিয়েছেন। অন্তত মহাকাব্য পড়ে ত তাই মনে হয়। আজগুবি গল্প বললে যে পাবলিকে খাবে ভাল। তাহলেই ভিক্ষে পাওয়া যাবে ভাল। কি আশ্চর্য! পাবলিকও বুঝত বিমানে অর্থ! তবেই না কবিরা পাবলিককে গান শুনিয়ে বোঝাতে পারতেন। পাবলিক যা বোঝেনা তা পাবলিক শোনেনা। তখনও শুনত না। এখনও শোনেনা।

পৌরাণিক বংশ পঞ্জিকার এক মত অনুযায়ী কুরু বংশের প্রাচীন এক রাজার নাম উপরিচর বসু। বলা হয় তিনি উপরে উপরেই চরে বেড়াতেন বলে তাঁর এই নাম হয়েছিল। ইন্দ্র তাঁকে স্ফটিক নির্মিত এক বিমান দান করেছিলেন। শুধু তাই না, তাঁকে ইন্দ্র চেদিরাজ্যের রাজাও করে দিয়েছিলেন। সেই থেকে বসু বিমানে চেপেই ঘুরতেন। ইনি বেদব্যাসের দাদু ছিলেন। ভীষ্মেরও দাদু ছিলেন।

বিমানে গমনাগমন খুবই অসাধারণ কিছু ছিলনা। রাজা ও ঋষিরা বিমানে চেপে পৃথিবী পর্যটনে সক্ষম ছিলেন। অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের কথাই ধরা যাক। ত্বাষ্ট্রা ঘোটকীর রূপ ধরে অন্তরীক্ষে ভ্রমণ কালে তাঁদের প্রসব করেন। এই দুই ভাই পেশায় ছিলেন বৈদ্য বা ডাক্তার। এখানে ওখানে চিকিৎসা করে বেড়ানোই তাঁদের প্রধান কাজ ছিল। বর্ণনায় পাওয়া যায় এঁদের কাছেও বিমান ছিল। বালখিল্য ঋষিরা ছিলেন বুড়ো আংলা। সেই মহর্ষিরা সূর্যমন্ডলে ও নভোমন্ডলে বিমানে চেপে ঘুরে বেড়াতেন। মহর্ষি শুকদেব অন্তরীক্ষ পথে সসাগরা পৃথিবী পরিভ্রমণ করতে সক্ষম ছিলেন। মহর্ষি দুর্বাসার কাছেও বিমান ছিল। যমলোক, ব্রহ্মলোক, পিতৃলোক, দেবলোক ও আরও নানারকম লোকে পৌঁছোনোর জন্যে বিমানের প্রয়োজন হত। পুরু বংশের রাজা দুষ্মন্তও বিমানে চেপে যাতায়াত করতেন। 

অর্জুনও বহুবার বিমানে চেপে যাতায়াত করেছেন। একবার তিনি ইন্দ্রের সারথি মাতলির সঙ্গে বিমানে চেপে ইন্দ্রলোকে গিয়েছিলেন। যাওয়ার পথে অর্জুন হাজার হাজার বিমান দেখেছিলেন। বলা হয়, এই সময়ে অর্জুন মাতলির সঙ্গে অমরাবতী নগরী যাচ্ছিলেন। তখন তিনি এক আকাশচর নগরও দেখেন। আগুনের মতো প্রভা ছিল সেই নগরের। সেই নগরে পশুপাখি, গাছপালা ছিল। বিভিন্ন রত্নাদি দিয়ে মোড়া ছিল সেই নগর। ওই নগরে প্রবেশ করার চারটে দুর্গম দ্বার ছিল। দানবেরা বিভিন্নরকমের অস্ত্র নিয়ে সেই দ্বার পাহারা দিত। বৈশ্বানর তনয়া পুলোমা ও কালকা। এদের সঙ্গে মারীচ দানবের বিয়ে হলে ষাট হাজার পুত্র জন্মায়। অর্জুনের দেখা সেই আকাশচর নগর ছিল পুলোমা ও কালকার ছেলেপিলেদের। এদের নাম ছিল পুলোমাজ এবং কালকাঞ্জ। পুলোমা ও কালকা পুত্রলাভের জন্যে তপস্যা করেন। তপস্যায় তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা বলেছিলেন যে দেবতা, সর্প ও রাক্ষসেরা এই পুত্রদের কোনদিন বধ করতে পারবেনা। ব্রহ্মা সেবার স্বনির্মিত একটা উড্ডীন নগর উপহার দিয়েছিলেন পুলোমা ও কালকাকে। নগরটির নাম ছিল হিরণ্যপুর। অর্জুন হিরণ্যপুরে ষাট হাজার দানব দর্শনে তাদের বধ করার জন্যে অস্ত্র নিক্ষেপ করেন। সেই অস্ত্রের প্রভাবে নগরটি কখনো ভূতলে পড়ে যাচ্ছিল। আবার কখনো শূন্যে উঠে যাচ্ছিল। কখনো টাল খেয়ে একেঁবেঁকে সরে সরে যাচ্ছিল। কখনো আবার ঝপাস করে জলে আছাড় খাচ্ছিল। 

নহুষের ছেলে যযাতি তাঁর পুত্র পুরুকে সিংহাসনে বসিয়ে সুরলোকে গমন করেছিলেন। তখন তিনি কিছুকাল অন্তরীক্ষেও বাস করেছিলেন। জীবনের পরবর্তীকালে যযাতি অন্তরীক্ষেই বাস করতেন। কার্ত্যবীর্য্য বিমানে চেপে যুদ্ধ করে বাসবকে হারিয়েছিলেন। দেবতারা কুবেরকে হংসযুক্ত ও মনোমারুতগামী পুষ্পক নামক এক দিব্য বিমান দিয়েছিলেন।

বিমান নির্মাণ করতে বিশ্বকর্মা পটু ছিলেন। তিনি ছিলেন দেবশিল্পী। তিনি ছিলে ইঞ্জিনিয়ার। প্রভাসের পুত্র বিশ্বকর্মা বিমান ছাড়াও প্রাসাদ, বাগান, সরোবর, তলোয়ার, অলংকার ইত্যাদি তৈরি করতে পারতেন। তিনি তখনকার আমলের একজন ডিজাইনিং কনসাল্টেন্ট ছিলেন হয়তো! তবে তিনি শুধু দেবতাদের জন্যে বিমান ইত্যাদি নির্মাণ করতেন। দানবকুলের ইঞ্জিনিয়ার ও ডিজাইনার ছিলেন ময়দানব। ইনিও বিশ্বকর্মার মতোই সবকিছুই নির্মাণও করতে পারতেন।

তখনকার দিনে সর্বসাধারণকে বিমানে চেপে ওড়ার জন্যে যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হত। অর্থাৎ পৃথিবীর জনগণ কঠোর তপস্যা করে দেবতাদের সন্তুষ্ট করতে পারলেই বিমানে চাপার বর পেতেন। দক্ষিণ সিন্ধুতীর্থে গেলে অগ্নিষ্টোমের ফল লাভ হত। এবং বিমানেও আরোহণ করা যেত। মচক্রুক তীর্থে মচক্রুক নামের এক দ্বারপাল দণ্ডায়মান থাকতেন। সেই চৌকিদারকে অভিবাদন করতে পারলে পদ্মবর্ণ যানে চেপে ব্রহ্মলোকে যাত্রা করা যেত।

দেবরাজ ইন্দ্রের আদেশে একবার যযাতিকে স্বর্গ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। স্বর্গচ্যূত হয়ে তিনি যখন ভূমণ্ডলে পড়ছিলেন তখন রাজর্ষি অষ্টকের সঙ্গে অন্তরীক্ষে তাঁর দর্শন হয়। অষ্টক তাঁকে পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। ওদের মধ্যে অন্তরীক্ষেই বার্তালাপ হয়েছিল। যদিও অষ্টক তখন অন্তরীক্ষে ছিলেন না। রাজর্ষি অষ্টক ছিলেন যযাতির নাতি। অষ্টক দাদুকে ভূমণ্ডলে পতিত হতে দেখে কয়েকটি প্রশ্ন করলেন। দাদু যযাতিও তার ঠিকঠাক জবাব দিয়ে গেলেন। দাদুর কাছ থেকে সঠিক উত্তর পেয়ে অষ্টক দাদুকে আর মর্ত্যলোকে না থাকতে দেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। নাতি মনস্থির করলেন দাদুকে আবার স্বর্গে পাঠাতে হবে। নাতিরাজা অষ্টক তাই তাঁর জন্যে সংরক্ষিত পাঁচটি আসন দাদুকে দিয়ে দেন। অষ্টক ওই আসনগুলো বিভিন্ন লোকে গমনাগমনের জন্যে ব্যবহার করতেন। তবে দাদু যযাতি যে যানে চেপে পৃথিবীতে অবতরণ করেছিলেন, তাও নেহাত মন্দ ছিলনা। জ্বলন্ত অগ্নিশিখার মতো সেই যান দেখে অষ্টকও আশ্চর্য হয়েছিলেন। যযাতির এই যান যে পরে অষ্টককে নিয়ে অন্তরীক্ষে গমন করবে একথা সুনিশ্চিত করে যযাতি পুনরায় অন্তরীক্ষে গমন করেছিলেন।

মহাসুর হিরণ্যকশিপুর বংশজ নিকুম্ভের দুই পুত্র। সুদ ও উপসুন্দ। তাঁরা একবার অমরত্ব পাওয়ার লোভে ব্রহ্মার কাছে তপস্যা করেছিলেন। তবে বেগতিক বুঝে ব্রহ্মা তাঁদের অমর করেননি। তিনি ওদের একটি বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছিলেন। বলা যায় বিশেষ যান দিয়েছিলেন। যাতে চড়ে দুই ভাই যখন খুশি ও যেখানে খুশি যেতে পারতেন। সুন্দ ও উপসুন্দ এই ক্ষমতা পেয়ে দেবতাদের বাসভবনে যখন খুশি হানা দিতেন। দেবতাদের তাঁরা যখন খুশি আক্রমণ করতেন।

একবার অর্জুনকে বেশ ঘটা করে সম্বর্ধনা জানানো হয়েছিল। কারণ তিনি পাশুপত অস্ত্র অর্জন করেছিলেন। তখন অর্জুনকে সম্বর্ধনা দিতে ধর্মরাজ যম। অদ্ভুতদর্শন ধনেশ্বর কুবের এসেছিলেন। পিতৃগণ যমের সাথে একই বিমানে এসেছিলেন। তাছাড়াও গুহ্যক ও গন্ধর্বরাও ছিলেন। এঁরাও বিমানে চেপেই এসেছিলেন।

অর্জুনকে ইন্দ্র ডাক পাঠালেন। সারথি মাতলির সঙ্গে অর্জুন চলেছেন। ইন্দ্রের একটি দিব্যরথ ছিলে। সেই রথের সারথি মাতলি। ওই দিব্যরথটা ইন্দ্র পাঠিয়েছিলেন। বর্ণনায় আছে অর্জুন কঠোর তপস্যার ফলে দেবত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তাই তাঁর দিব্যরথে চড়তে কোন অসুবিধা নেই। অর্জুন চলেছেন মাতলির সঙ্গে। পৃথিবী তাঁর দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। চারদিক অন্ধকার। রাস্তায় সূর্য বা চাঁদের আলোর দেখা নেই। আগুনও জ্বলছে না। আগুন জ্বালানোর তাই উপায় নেই। এই ভাবেই অর্জুন অন্তরীক্ষ পথে যাত্রা করে ইন্দ্রলোকে পৌঁছোলেন।

একবার রাজা নহুষ অজগরের রূপ ধরে মর্ত্যলোকে বাস করছিলেন। তখন তাঁর সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের দেখা হয়েছিল। তিনি যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন যে তিনি নাকে দেবলোকে দিব্যবিমানে চেপে যাওয়া আসা করতেন।

লোমশ নামের এক মুনিও বিমানে চেপে ঘুরে বেড়াতেন। এমনভাবে ঘুরতেন যেন এপাড়া থেকে ওপাড়া যাচ্ছেন। অর্জুন যখন মাতলির সঙ্গে দিব্যরথে চেপে ইন্দ্রলোকের পথে যাচ্ছেন তখন যুধিষ্ঠির চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। অনেক দিন হয়ে গেলেও অর্জুনের কোন খবরাখবর না পেয়ে তিনি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। ইন্দ্র যুধিষ্ঠিরের উৎকণ্ঠা টের পেয়ে লোমশ মুনিকে পাঠালেন অর্জুনের খবরাখবর নিয়ে যুধিষ্ঠিরের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে। লোমশ মুনি তৎক্ষণাৎ অন্তরীক্ষ পথে অর্জুনের কাছে উপস্থিত হলেন। অর্জুনের সঙ্গে বার্তা বিনিময় করে তিনি পরক্ষণেই কাম্যকবনে যুধিষ্ঠিরের কাছে হাজির। যুধিষ্ঠিরকে অর্জুনের বার্তা দিয়েই আবার তিনি পর্ব, নদী, নালা, বন, জঙ্গল, সরোবর, জনপদ না টোপকে একেবারে সরাসরি ইন্দ্রলোকের পথে যাত্রা করলেন। যে পথে তিনি এসেছিলেন সেই পথেই তিনি ফিরে গেলেন।

বাহুকবেশী নল এবং ঋতুপর্ণরাজও একবার আকাশপথে নদ, নদী, পর্বত, সরোবর সমস্ত অতিক্রম করে মহাবেগে যাত্রা করেছিলেন। নলের রথের ঘোড়াগুলো ছিল কদাকার। কিম্ভূতকিমাকার ঘোড়াগুলোর পায়ে চাকা লাগানো ছিল। শুধু পায়ে কেন, সর্বাঙ্গে চাকা লাগানো ছিল। কপালেও একটা করে চাকা ছিল। মাথায় দুটো। পাশে চারটে। বুকে দুটো। পিঠে একটা চাকা। ঘোড়ার গায়ে এতগুলো চাকা দেখে ঋতুপর্ণের ঘোর অপছন্দ হয়েছিল। ঘড়াগুলোর চোয়াল ছিল চওড়া। নাক ছিল অত্যধিক সরু। কিন্তু ওই ঘোড়াগুলোর গতি দেখে ও আকাশমার্গে স্বাচ্ছন্দ্য ভ্রমণ দেখে ঋতুপর্ণরাজ অশ্ববিদ্যা শেখানোর জন্যে নলকে আবেদন করেন। নল ও ঋতুপর্ণের কাছ থেকে ওই ফাঁকে সংখ্যাবিদ্যা শিখে নিয়েছিলেন।

কৈলাশ পর্বতের উত্তরের মঙ্গলময় সর্বৌষধি গিরি। সবরকমের ওষুধপত্র ওই পাহাড়ে পাওয়া যেত। ওই পাহাড়ের পাদদেশে এক সরোবর ছিল। তার নাম বিন্দুসর। বিন্দুসরের কাঞ্চনময় বালুকাবেলায় মণিময় ফুলসকল ও হিরণ্ময় বিমানশ্রেণী দেখা যেত।

হিড়িম্বানন্দন ঘটোৎকচ একবার দ্রৌপদীকে ঘাড়ে করে অন্তরীক্ষে যাত্রা করে বদরি নামের এক আশ্রমে পৌঁছোলেন। সেখানে তাঁরা কাঁটাশূন্য কুল গাছ দেখেছিলেন। অন্যান্য রাক্ষসদের ঘাড়ে চেপে পঞ্চপাণ্ডবরাও বদরিকাশ্রমে পৌঁছোলেন। বলা হয় দ্বিতীয় সূর্যের ন্যায় প্রজ্বলিত হয়ে লোমশ মুনিও ওই যাত্রায় সামিল ছিলেন। বিমানের উল্লেখ না থাকলেও কল্পনা করতে ক্ষতি কোথায়। এতটা পথ যারা নিমেষে পৌঁছে যেতেন তাঁরা নিজেরাই বিমানের চেয়ে কম কি!

বিমান ছাড়াও বিশ্বকর্মা ও ময়দানব বিভিন্ন ধরণের উড়ুক্কু সভা বা শিবির বা শহর তৈরি করতে পারতেন। ময়দানব যুধিষ্ঠিরের জন্যে এক অপরূপ সভা তৈরি করেছিলেন। সেই সভা দেখে যুধিষ্ঠিরের তো চোখ ছানাবড়া। তিনি ভাবলেন তাঁর সভার মতো কোন সভা ভূমন্ডলে নেই। ভূমন্ডলের আরও অন্যান্য সভার বিষয়ে জানতে নারদকে ধরলেন তিনি। 

নারদ থকন ইন্দ্রের সভার বর্ণনা দিয়েছলেন। বিশ্বকর্মাই ওই সভা তৈরি করেছিলেন। ওই সভা শূন্যে অবস্থান করত। যথেচ্ছে গমন করতে পারত। ওই সভায় অনেক রকম বড়ো বড় প্রাসাদ, বেদী ও দিব্য গাছপালায় ভর্তি ছিল। অনেক দেবর্ষি, মহর্ষি ও রাজর্ষিরা বিমানে চেপে সেই সভায় রোজ যাতায়াত করতেন। ওই সভায় জরা, ভয়, শোক ও ক্লান্তি জাতীয় কোন কিছুই অনুভূত হত না। 

বিশ্বকর্মা যমরাজের জন্যেও এরকম একটি সভা তৈরি করেছিলেন। যমের সভাও যেখানে খুশি যেতে পারত। এই সভার আবহাওয়া ছিল নাতিশীতোষ্ণ। সূর্যের মতো তেজ ছিল। মনোরম পরিবেশ ছিল সেখানে। নানারকম সুস্বাদু খাদ্যসামত্রী ছিল সেখানে। কুবেরের সভাও শূন্যমার্গে অবস্থিত মনে হত। বলা হয় গুহ্যকগণ এই সভা বহন করতেন বলে একে শূন্যে অবস্থিত মনে হত। ব্রহ্মার সভার তো তুলনাই চলেনা। ওই সভাই শূন্যে অবস্থান করত। কোন অবলম্বন ছাড়াই ব্রহ্মার সভা শূন্যে বিরাজমান থাকত। এক জায়গায় স্থির থাকতে পারত। ক্ষণে ক্ষণে ওই সভা নানারকম রূপ ধারণ করতে পারত। ওই সভা যে কত বড় ছিলে যে বিষয়ে কেউই কোন আন্দাজ করতে পারতনা।

সৌভনগরী ছিল এক আকাশচর নগর। সৌভরাজ শাল্ব ওই উড্ডীন নগরে চড়েই যুদ্ধ করতেন। শিশুপাল বধ হওয়ার পর শাল্ব ওই উড়ন্ত নগরে চেপেই দ্বারকা আক্রমণ করেছিলেন।শাল্ব নামের সেই দুরাত্মা দানব আকাশচর সেই নগরের চারপাশে ব্যূহ স্থাপনা করে তার মধ্যেই বসে থাকতেন। শাল্ব দ্বারকাপুরী আক্রমণ করার ফলে রুক্মিনীনন্দন প্রদ্যুম্নের সাথে তুমুল লড়াই হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত শাল্ব সৌনগরী নামের ওই উড়ুক্কু যানে চেপে দ্বারকাপুরী ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন।

পালালে কি হবে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শাল্বকে তাড়া করলেন। অনেক দেশ, পর্বত, নদী, সরোবর, বন ও জঙ্গল পেরিয়ে কৃষ্ণ মার্ত্তিকাবত নগরে উপস্থিত হলেন। সেখানে শোনা গেল শাল্ব সৌভনগরে চেপে সমুদ্রের দিকে রওনা হয়েছেন। কৃষ্ণও পেছন ধরলেন। অবশেষে কৃষ্ণ সেই উড়ুক্কু শহরের দেখা পেলেন। তিনি জমি থেকে অনেক উঁচুতে ওই নগরকে দেখতে পেলেন। এত উঁচুতে যে কৃহ্ণের সৈন্যেরা ওখানে পৌঁছোতে পারলেন না। তবে ভগবান কৃষ্ণের ছোঁড়া তীর সেখানে পৌঁছোল। সেই তীরের দংশনে শাল্বের বহু সৈন্য নগর থেকে টপাটপ সমুদ্রের জলে পড়তে লাগলেন।

চলবে.......