বহরমপুরের কংগ্রেসি বিধায়ক এবং রাজ্যের মন্ত্রী মনোজ চক্রবর্তী মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করার সময়ে বলেছিলেন আর কোনদিন মহাকরণে ফিরবেন না। মুখ্যমন্ত্রীকে স্বৈরতন্ত্রী এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ আখ্যা দিয়ে তিনি মহাকরণ ত্যাগ করেছিলেন। তার প্রত্যুত্তরে নতুন তৃণমূলী মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস তাঁকে পাগল, অশিক্ষিত ও অভদ্র বলে দিলেন। কিছুদিন পর কংগ্রেসের বহরমপুরের সাংসদ অধীর চৌধুরি বর্তমান রাজ্য সরকারকে উন্মাদ বলে দিলেন। অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র কেন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলেন। কেন্দ্র সরকার নাকি তাঁকে একটি পয়সাও দিচ্ছেনা। পরের দিন অভিষেক মনু সিংভি হিসেব করে দেখিয়ে দিলেন অর্থমন্ত্রীর দেওয়া তথ্য বিভ্রান্তিকর। কয়েক মাস আগে মমতা বলে দিলেন ঘর করতে হলে কংগ্রেস তাদের সঙ্গে বাধ্য ছেলের মতো ঘর করুক। নয়তো দূর হয়ে যাক। তার কয়েকদিন পর কংগ্রেসের সাংসদ ও কেন্দ্রের গ্রামোন্নয়নমন্ত্রী জয়রাম রমেশ তখন বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে রাজ্য সরকারকে চিঠি লিখে জানালেন রেগার কাজে পশ্চিমবঙ্গ পিছিয়ে পড়েছে।

কৃষকমৃত্যুর বিরুদ্ধে হঠাৎ প্রদেশ কংগ্রেস গলাবাজি শুরু করে দিল। নিজেদেরই সরকারের ভ্রান্ত নীতির সমালোচনা করে বসল। দুমদাম করে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ জানাতে শুরু করল। যারা মন্ত্রী হয়ে কিছু বাগিয়ে নিয়েছে সেই সব কংগ্রেসি নেতারা যারা মন্ত্রী হতে পারেননি তাদের দিকে আঙুল তুললেন। কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের ফলে ক্ষেপে যাওয়া কংগ্রেসিরা আবার গলার শুর নিচু করে ফেললেন। কেন্দ্রের শাসনে মমতা সবচেয়ে বড় শরিক। মমতাকে খুশি রাখতে গিয়ে কেন্দ্রকে অনেক ক্ষেত্রে ঢোঁক গিলতে হচ্ছে। খুচরো ব্যাবসায় বিদেশি বিনিয়োগ আনতে অসুবিধে হচ্ছে। পেট্রোপণ্যের দাম বাড়াতে গিয়ে নাটকের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের আগের বছর ভোটের সময় দাম বাড়ানো যায়নি। যদিও ভোটের পরে হুটহাট করে বেশ কয়েকবার দাম বেড়ে গেছে। রেলের পণ্যমাশুল বেশ কয়েকবার বেড়ে গেলেও সস্তার জনপ্রিয়তার জন্যে যাত্রীভাড়া বৃদ্ধি হতে দেননি মমতা। এসব ব্যাপারের মমতা বারবার কেন্দ্রের জোট ছেড়ে বেরিয়ে আসার হুমকি দেন। সাপ ছুঁচো গিললে যে অবস্থা হয়, কেন্দ্রের এখন তাই অবস্থা। প্রদেশ কংগ্রেসে অশান্তির হাওয়া উঠলে কেন্দ্র থেকে হাওয়া ঘুরিয়ে দেওয়ার কাজ করছেন কেন্দ্রের কংগ্রেসি হেভিওয়েটরা। কেউ কেউ বলে দিলেন শরিকদের মধ্যে ঝগড়া বাধানোর মূলে রয়েছেন ‘নারদ মুনি’ বিজেপি। কেন্দ্রের অবস্থা সাপের ছুঁচো গেলার মতো হলেও প্রদেশ কংগ্রেসের অবস্থা উল্টো। এখানে ছুঁচো সাপ গিলতে চেষ্টা করেছে। তাই অযথা সাপের ফোঁসফোঁসানি শুনতে হচ্ছে কংগ্রেসকে।

এদিকে ইন্দিরা ভবনের নাম পালটানো নিয়ে রাজ্যে শরিক দলের মধ্যে ঝগড়া বেধেছিল। কংগ্রেসিরা বলেছেন ইন্দিরা ভবনের নাম পরিবর্তন কিছুতেই মেনে নেওয়া হবেনা। এই বিষয়ে কয়েক প্রস্থ চিঠি চালাচালি হয়েছে। মিটিং মিছিলও হয়েছে। একপ্রস্থ ঝগড়াঝাঁটি করে আবার সবাই ঠান্ডা। ইন্দিরা ভবনের নাম পরিবর্তনের বিতর্কে কংগ্রেসের মমতার পেছনে লেগেছিল বলে মমতা এই বিতর্কের পেছনে সিপিআইএম-এর ষড়যন্ত্রের আঁচ পেলেন। বাবু যত বলেন তার চেয়ে শতগুণ বলেন পারিষদরা। পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্র বললেন, মমতার ছবি ছাড়া ভোটে লড়লে কংগ্রেসের জমানত জব্দ হবে। শিল্পমন্ত্রীও আরেকটু সুর চড়িয়ে বললেন, রাজ্যের উন্নয়ন দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাচ্ছে সিপিআইএম, তার সঙ্গে গলা মিলিয়েছে সিপিআইএম-এর বি টিম কংগ্রেস। এর মাত্র দুদিন আগেই কংগ্রেস মেট্রো চ্যানেলে মমতার দলকে সিপি আইএম-এর বি টিম বলেছিল। ঝগড়া তুঙ্গে উঠলেও সিপিআইএম-এর ভয়ে দুটি দলই এক ঘাটে জল খাচ্ছে। শিল্পমন্ত্রী তো তাঁদের জোটের মন্ত্রী মানস ভুঁইঞাকে উদ্দেশ্য করে বলে দিলেন, মমতার দলের সমালোচনা করলে তাঁর মন্ত্রীসভায় থাকাই উচিত নয়। তবু রয়ে গেলেন মানস ভুঁইঞা।

এবার মহাকরণে চিটফান্ড নিয়ে মুখ খুললেন কংগ্রেস নেতা আবু হাসেম খান চৌধুরী। মহাকরণে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে আবু হাসেম খান চৌধুরী জানান, এ বিষয়ে ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, রাজ্যে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা চিটফান্ডগুলি গরীব মানুষের টাকা নিয়ে প্রতারণা করছে। চিটফান্ডের কারবারিদের মধ্যে কয়েকজন তৃণমূলী কেউকেটা আছেন বলেই কংগ্রেস রাজ্যে চিটফান্ড নিয়ে সরব হয়েছে বলে অনুমান। রাজ্যে পঞ্চায়েতস্তরে সরকারি হস্তক্ষেপের বিরোধিতার আভাস তাঁরা বরাবরই দিয়ে রেখেছিলেন। অথচ জোটের বিরোধিতার তোয়াক্কা না করেই পঞ্চায়েতে সরকারি হস্তক্ষেপ বেড়ে চলেছে। সম্প্রতি সংবাদপত্রের বিরোধিতা করে চলেছে প্রদেশ কংগ্রেস। অথচ তাঁদের শাসনকালে সংবাদপত্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল।

সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, রাজ্যের পঞ্চায়েত ভোটে একলা লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিল প্রদেশ কংগ্রেস। অনুমান করা হচ্ছে। জোটের মধ্যে খটাখটির জেরেই যে প্রদেশ কংগ্রেস এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত নিল। এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে দুর্বল কংগ্রেস নিজের পায়ে কুড়ুল মারার কাজ করছে। একলা চলার সিদ্ধান্ত বানচাল করতে আবার দিল্লির কংগ্রেসকে মাঠে নামতে হতে পারে। প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্বের অনুমান, কংগ্রেসই এ রাজ্যে একমাত্র প্রকৃত শক্তিশালী দল। তার প্রমাণ তাঁরা পঞ্চায়েত ভোটের মাধ্যমে মমতাকে জানিয়ে দিতে চাইছেন। দিল্লির কংগ্রেস প্রদেশ কংগ্রেসকে কালিদাস ভেবে নিয়ে এই শক্তি পরীক্ষা আটকে দিতে তৎপর হতে পারে। দেখা যাক দিল্লির নেতারা পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেসিদের এখন স্বাবলম্বী ভাবছেন কিনা। পশ্চিমবঙ্গে হামাগুড়ি দিতে অক্ষম কংগ্রেসিরা পঞ্চায়েত ভোটে কি ভাবে দৌড়বেন তা দেখার ইচ্ছে থাকল।